আমি এলেম বিলেতে উড়োজাহাজে চেপে সেই সুদূর বাংলাদেশ হইতে যেথায় আমারে মানুষ ছাপোষা একটি শাক গন্য করে। যদিও মান বাড়ে ইলিশের মাথা-ল্যাজা দিয়ে বা চিংড়িমাছ দিয়ে সব বাঙালির ঘরে সে বিশ্বের যেথায় বসবাস করুন। সে যাক তবে একটা নাম ও আছে আমার, কেমন যেন তাচ্ছিল্য করে দেওয়া – পুঁইশাক। গুণে ও স্বাদে আমি এতোই পছন্দের যে এই বাঙালি জাতি যতোই দাম দিতে হোক আর যেখানেই থাকুক আমারে চায়, আমারে ভালোবাসে। রূপেও আমি কম নয়, বড়-বড় , চকচকে পাতা আমার , দেখেই বাঙালির জিভে অজান্তেই জল সরবরাহ হয়। এইখানেই শেষ নয়, পুঁইশাকের কড়চা। এবার শুরু হোল পুঁইশাকের আসল কথা।
বিলেতে ১ কিলো পুঁইশাক কিনলেন স্লোহ শহরের এক গ্রাহক। বাড়ির কর্তা দুটো-তিনটে ছোট ডাঁটা কেটে রেখে পুঁতলেন ছোট ছোট টবে আর যত্ন করে রাখলেন তাদের ইউটিলিটি রুমে। একটা ডাঁটা বড় হওয়া আরম্ভ করলো, তার ডানা গজানোর মতন পাতা গজানো শুরু হোল আর সেই গৃহবাসিদের ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ দেওয়ার মতন বড় হলে কি ভাবে রান্না হবে সেই প্লান শুরু হোল। এদিকে আমি বিলেতের আবহাওয়ার মধ্যেই ভালো ভাবে বড় হতে লাগলাম। তারা আমার বাড় যাতে আরো বাড়ে, আমায় যত্ন করে তাদের টিভি রুমে নিয়ে এসে (যে হেতু বিলেতের খামখেয়ালী আবোহাওয়া, ঠান্ডার দিকেই হেলিয়ে থাকা আর আমি বাপু সূর্যিমামার আদর ছাড়া থাকতে পারিনা) বাইরে না রাখতে পেরে কাঁচের দরজা দিয়ে যাহাতে ‘সূর্যিমামা দেয় হামা’ দেখতে পাই, এনে বসিয়ে দিলো। আমি সূর্যিমামা দেখে ও বাইরে বাগান দেখে তরতরিয়ে উর্ধমুখী হয়ে উঠলাম। আমায় আর কে ধরে তখন। এতো বাড় বাড়লো আমার যে গৃহকর্তা আমার বাড় সামলাতে নাকানি-চোবানি খেতে লাগলেন। তাই লম্বা কঞ্চি এনে বসালেন ,যাহা জড়িয়ে আমি বেড়ে উঠতে-উঠতে সেটাকে ও ছাপিয়ে গেলাম। যেন দুজনের মধ্যে একটি শীত-যুদ্ধ শুরু হোল। যদিও দুই পক্ষই আনন্দিত এই শীত যুদ্ধে । কারণ দুজনেই চাই এই মজার যুদ্ধ। যতই দ্রুত গতিতে বাড়ছি, তিনি ততোই খুশি মনে সেটার সযত্নে বাড়তে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। আমি যখন ঘরের সিলিং ছুঁই ছুঁই তখন গৃহকর্তা আমাকে গোল করে ঘুরপাক খাইয়ে বেঁধে দিলেন। আমি তাইতেই ও খুশি। গৃহবাসিরা আমার বাড়ন্ত গতিবিধির উপর নজর রাখছেন আর আনন্দে আঠখানা হচ্ছেন। আমিও আনন্দে আঠখানা হয়েছিলাম। হবার কথাও- একে আমি বিলেতে তারপরে আবার দেশের বন-বাদাড়ে নয়, একটি বাড়ির টিভি রুমে, দামী সার দেওয়া ফুলের টবে, কাঁচের দরজা ভেদ করে প্রতিদিন বাইরের বাগানের দৃশ্য দেখি আর বেড়ে চলি।গতকাল আমাকে কেটে ফেলে বিলেতের কিচেনের (রান্নাঘর বললে সিন্ক বলা শোভা দেবে না)সিন্কে ফেলে গৃহণী ঠান্ডা’গরম জলের কল খুলে অবগাহন করলেন, কাটলেন আর গরম তেলে ফোড়ন দিয়ে কড়ায়ে দিলেন আর তারপর ঝপাঝপ আলুর টুকরো, বেগুনের টুকরো, কুমড়ো টুকরো, শিমের টুকরো, আদা বাটা সহ নানান মসলাপাতি পড়লো। কাঁচা লঙ্কা ও এসে হাজির হল।
জমিয়ে আড্ডা চলছিল আমার সাথে এই সকলের। ওমা, যখন আমরা উনুন থেকে নামবো-নামবো করছি দেখি ইলিশ মাছের ল্যাজার ও মুড়োর ভাজা টুকরোগুলো টপাটপ এসে পড়লো আর এমন ভাবে মিশে গেলো যেন কতো কালের চেনা-জানা। আমরাও তার গন্ধে মেতে উঠলাম। গৃহকর্তা ইলিশ মাছের মাথা দেওয়া এই পুঁইশাকের চচ্চড়ি খেয়ে রান্নাটির প্রশংসা করলেন। যা উনি কখনোই করেন না । এখন গৃহণী ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না যে রান্নাটি কি সত্যিই ভালো হয়েছিলো নাকি আমার ( পুঁইশাক) প্রতি তার অগাধ ভালোবাসাই তাঁর চচ্চড়ির প্রশংসার দাবিদার। হাজার হোক তিনি ভালোবেসে মোরে নানা রকম যতনে আমাকে খাইয়ে-দাইয়ে বড়ো করেছেন, চর্ব্য-চষ্যো করে খেয়েছেন ।একটুও প্রশংসার বহিঃপ্রকাশ তো হবেই। তাই হয়েছে। আমি বিলেতে বড়ো হওয়া পুঁইশাক আপ্লুত হলাম।