রবি ঠাকুর কে নিয়ে আমরা অনেক কথা , গান -বাজনা, নাচ, নাটক ও আবৃত্তি এবং উৎসব সব কিছুই চালিয়ে যাচ্ছি তাঁর জন্মবার্ষিকী তে ফেসবুক দেয়াল গুলোতে। দেশে ও বিদেশে এবারে আবার অনলাইনে বেশি করে চলছে এই লকডাউনের পরিবেশে। কিন্তু একবার ও কবিগুরুর খাওয়া-দাওয়ার কথাটা বলা হচ্ছেনা বা হলেও আমার চোখে পড়েনি।
এটা সর্ববিদিত যে রবি ঠাকুর ভোজনরসিক ছিলেন আর নিজেও কয়েকটা খাবারের নামকরন করেছিলেন। যেমন ‘এলোঝেলো’র নাম দিয়েছিলেন ‘পরিবদ্ধ’। যদিও সেটার তেমন ব্যবহার হয়নি। পত্নী মৃণালিনী দেবী রান্নায় হাতের গুণের কথা তো সকলেই জানেন। তিনি যশোরের মেয়ে ছিলেন আর তাঁর অসামান্য হাতের গুণে তিনি মুহূর্তে জয় করে নিয়েছিলেন নাটোরের মহারাজা যোগনিন্দ্র রায়ের মন। তিনি নিজে হাতে বানিয়েছিলেন চিড়ের পুলি , দইয়ের মালপো আর পাকা আমের মিঠাই। তাঁর হাতের মানকচুর জিলিপি নাকি খেতে অসাধারণ হতো। যে একবার খেয়েছে , সে বারবার সেই সৌভাগ্যের বায়না করতো ।
মৃণালিনী দেবী যেমন রান্নায় উৎসাহী ছিলেন তেমন লোকেদের দেদার খাওয়াতেও ভালোবাসতেন । কবি গুরুর ‘খামখেয়ালি সভা’র দলের লোকেরা তাঁর হাতের নানা ধরনের নতুন পদ খাবার সুযোগ পেতেন। সে সবগুলোর সৃষ্টিকর্তা কিন্তু কবি নিজে ছিলেন আর নিজেও অল্পাহারী হলেও তিনিও লোকজনদের খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন।
কবিগুরুর নানা রকমের খাওয়া নিয়ে নানান রকমের রসিকতা ও জানা যায় । একবার নাকি লেখক বনফুল স্ত্রীকে (উনি সুপ্রিয়া চৌধুরীর দিদি ) নিয়ে জোড়াসাঁকোয় গুরুদেবের সাথে দেখা করতে যান। ওঁনার স্ত্রী নিজে হাতে করা মিষ্টি যখন কবিগুরু কে দিলেন তখন কবি রসিকতা করে বলেছিলেন , ” বাংলায় তো দুজনই রসশ্রষ্ঠা – এক হলাম আমি আর এক দ্বারিক ঘোষ ! তুমি আবার কবে থেকে রসশ্রষ্ঠা হয়ে গেলে ?”
আর একটি মজার ঘটনার কথা জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ বনফুল কে একবাটি ঘুগনি পরিবেশনের সময় মাঝে একটি লঙ্কা বসিয়ে পরিবেশন করতে বলেন আর একটি কথাও যুক্ত করেন, “তুমি তো ঝাল খেতে বেশি পছন্দ করো।” সেটা নাকি রবীন্দ্রনাথের লেখার কয়েকটা বনফুলের কটাক্ষ পড়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন।
কবিগুরু কিন্তু লুচি খেতে ভীষণ ভালো বাসতেন যদিও অল্প খেতেন তবুও রাতের খাওয়া ও জলখাবারে এগুলো একটি বরাদ্ধ খাবারের মধ্যেই ছিল। এই ব্যাপারে একটি ঘটনা জানা যায়।
একবার রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজী একসঙ্গে বসে সকালের জলখাবার খাচ্ছিলেন। গান্ধীজীকে দেওয়া হয়েছিল ওটসের পরিজ। কারণ গান্ধীজী লুচি পছন্দ করতেন না। তবে রবীন্দ্রনাথ খাচ্ছিলেন গরম গরম লুচি। গান্ধীজী তাই দেখে বললেন, “গুরুদেব, আপনি জানেননা যে আপনি বিষ খাচ্ছেন।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “বিষই হবে, তবে এর অ্যাকশন খুব আস্তে-আস্তে। কারণ, আমি বিগত ষাট বছর যাবত এই বিষ খাচ্ছি।” সেখানে উপস্থিত থাকলে গুরুদেব কে বলতাম , “গুরুদেব আপনার গানটা যদি হয়ে যায় এই সুবাদে , “আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান।”
আর একটা মজার ঘটনা জানা যায় যে জীবনের শেষ কয়টি বছর কবি মংপুতে গ্রীস্মকাল মৈত্রয়ী দেবীর আতিথ্যযে কাটিয়েছিলেন। রুপোর থালায় করে মৈত্রয়ী দেবী নিজে হাতে করে ৮০ বৎসরের কবি কে বিস্তারিত মেনুতে পরিপূর্ণ খাবার পরিবেশন করতেন। কবির খাওয়াতে সেই সময়ে বেশ রেস্ট্রিকশন্স ছিল। দুপুরে বরাদ্ধ ছিল সুক্তানি , ডালনা , ডাল , তরকারি , মুরগির ঝোল আর শেষ পাতে মিষ্টি , যদিও খাবার খাওয়ার প্রথমেই কবি একটি আম নিজে হাতে কেটে খেতেন। মেনু টা বিস্তারিত হলেও খাওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই পরিমানে কম হতো।
যাক রবীন্দ্রনাথ যখন মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন তখন একবার মৈত্রয়ী দেবী রান্না করা ছাগলের ব্রেন/মগজ দিয়েছিলেন আর তাই নিয়ে কবির বিস্তর ঠাট্টার কথা জানা যায়। রোজই বিভিন্ন রকমের নিরামিষ রান্না হয়। একদিন হঠাৎ ব্রেন/মগজ আনা হয়েছে। কবি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এই পদার্থটি কি?” মৈত্রেয়ী দেবী উত্তর দিলেন,”ব্রেন”। কবির চোখে-মুখে কপট গাম্ভীর্যের রেখা ফুটে উঠল। বললেন, “বিশ্ব কবির ‘ব্রেনে’ ঘাটতি পড়েছে এ কথাটি সোজাসুজি জানালেই হতো। এত কৌশল করা কেন? যাকগে, এই তর্কের চাইতে জরুরী ব্যাপার যখন সামনে তখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকাই বা কেন?” বলে খাওয়া আরম্ভ করেছিলেন ।
কবি কিন্তু দেশে ও বিদেশে যখনই বেড়াতে বা নিমন্ত্রিত হয়ে গেছেন, প্রতিটি জায়গা থেকে মেনুকার্ড নিয়ে আসতেন আর বাড়ি এসে সেগুলোর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। এতোবার বিদেশের নানান জায়গা বেড়িয়ে ছিলেন বলেই ঠাকুর বাড়ির রান্নাঘরে দেশী-বিদেশি রান্নার পদগুলোর যেমন পরীক্ষা-নীরিক্ষা হোত তেমনই খাওয়া-দাওয়াও চলতো।
কবি লাঞ্চে বাঙলা খাবার খেতেন আর রাতের ডিনারে বিদেশি খাওয়া যেমন সুপ, একটু মাংসের রোস্ট বা মাছ ইত্যাদি। কবি কিন্ত সর্বদাই কাঁটা-চামচ ও চামচ ব্যবহার করতেন। মনে প্রাণে কিন্তু খুব সাধারণ খাবার পছন্দ করতেন।
সেই যুগে সম্পন্নদের হেঁসেলে পোলাও এবং পানতুআর আনাগোনা রীতিমতো পুরো দস্তুরে চলতো। তাই উনি খাওয়া দাওয়া কে সহজ সরল রাখার কথা বলতেন আর সেরকমটি খেতেন ।
কয়েকটি রেসিপি নিজেই আমদানি করে মৃণালিনী দেবীকে রাঁধতে বলতেন যেমন পাঁঠার বাঙলা, পাঁঠার মাংসের অল্প মসলা দেওয়া ঝোল, এঁচোড়ের দই মাছ আসলে এতে কিন্তু মাছই নেই বা মাছের মুরগির ঝোল এতে কিন্তু মুরগি নেই। এই সব বায়না মৃণালিনী দেবী উৎসাহ নিয়ে পরিপূর্ণ করতেন। কবি ভোজন রসিক হলেও অল্পাহারী ছিলেন। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর কবির খামখেয়ালী সভার বন্ধুরা মৃণালিনী দেবীর রান্নার প্রশংসা করতেন তাই শুনে কবিগুরু ও ভাবুক হয়ে পড়তেন।
রবীন্দ্রনাথ বাড়ির মেয়েদের রান্নার রেসিপি লিখে রাখার কথা বলতেন আর তাই তারা রেসিপির খাতা বানিয়েছিলেন। ঠাকুর বাড়ির রান্নার রেসিপিগুলো নিয়ে যেমন নানান পরীক্ষা -নিরীক্ষা চলতো এবং এই নিয়ে আবার ঠাকুর বাড়ির মেয়ে-বৌদের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা ও ছিলো। সেই জন্যেই ঠাকুর বাড়ির সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র সুনন্দ ঠাকুরের মতে পূর্ণিমা ঠাকুর, ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না’ বইটিতে রেসিগুলোর আসল স্বাদটিকে গুপ্ত, রাখার উদ্দেশ্য রেসিপিগুলোর উপকরণগুলোর কোন মাপ দেননি। যাইহোক আমি কবিগুরুর ১৭১তম জন্মবার্ষিকীতে আমার শ্রদ্ধাঙ্জলী যাপন করে আমার এই এলোমেলো লেখাটির এখানেই ইতি টানছি। এই লেখাটির সঙ্গে নিজেও খাদ্যরসিক সুবাদে ঠাকুর বাড়ির কয়েকটি রান্না করে ছবি দিলাম। আর রবি ঠাকুরের মতন লুচি ও খেলাম।
ছবি: পপি দে