বড়ে হনুমানজির দর্শন আমার জন্যে অপরিহার্য , এলাহাবাদে গেলেই দর্শন করি , ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করি আর না করি, কুম্ভমেলা বা মাঘ মেলায়ে যাই বা অন্য কোনো সময়ে যাই ।তাই বেরিয়ে পড়লাম পরের দিন একলাই , আবার ত্রিবেণী সঙ্গমের উদ্দেশ্যে । এই দিন কোনো রাজকীয় স্নানের তিথি ছিলোনা বলে, ট্রাফিক এর তেমন রেস্ট্রিকশন ছিলোনা , তাই ভাইয়ের বাড়ি থেকে অটোতে করে প্রয়াগরাজ স্টেশনের কাছে নেমে পড়লাম , তারপর সেখান থেকে আবার ই-রিক্সায় সঙ্গমে গেলাম।
ভালো রকমের ভীড় , যারা কাল রাজকীয় স্নান করতে পারেননি , আজ কে এসেছেন। আর একটা বা শেষ শাহী বা রাজকীয় স্নান হবে শিবরাত্রি তে তারপর মেলা শেষ। তাই মাঘী পূর্ণিমার স্নানের পর অনেকেই পাততাড়ি গুছিয়ে নিচ্ছেন এবং অনেকেরা তোলাতুলিও শুরু করে দিয়েছেন , আমি দোকানগুলোর কথা বলছি। তাঁদের অস্থায়ী মেলার জন্যে পাতানো দোকানগুলোর এখন যাবার পালা, সেটা তাদের হাবভাব দেখে বুঝতে পারছিলাম।সঙ্গম- নগরীর প্রাঙ্গনে ঢোকার অনেক আগে থেকেই ট্রাফিক রেস্ট্রিকশান, তাই হাঁটা শুরু করলাম। হেঁটেই চলেছি কারণ অনেকটা হেঁটে গেলে বড় হনুমানজির মন্দির এর দেখা পাবো । চারদিকে পুলিশ ও তাদের ও ওপরের কর্তারা বেশ ভালো ভাবে ও সৎ ভাবে নিজের কাজ করছেন দেখে বেশ ভালো লাগছিলো। একে যেতে দিলো , তাকে দিলোনা এইধরনের নালিশের কোনো প্রমাণ পেলামনা। তাই হেঁটে পথ চলতে খারাপ লাগছিলোনা। শেষে মন্দিরের কাছে এসে পৌঁছালাম। বিরাট লাইন আর একদিকে জুতো রাখার জায়গা সেটা আবার প্রস্থান দ্বারের কাছে । সেখানে জুতো রেখে , প্রবেশদ্বারে আসতে হবে । তাই করে আমিও দর্শনার্থীর দলে যোগ দেবো বলে ঠিক করার আগে মন্দিরের লাগোয়া দোকানগুলোর থেকে ফুল ও বেসনের লাড্ডু কিনলাম মন্দিরে দেওয়ার জন্যে। হনুমানজির প্রিয় ভোগ হলো বেসনের লাড্ডু । তাই কিনে লাইন এ দাঁড়ালাম । ওই লাইন এ থাকার সময়ে কয়েকটা ভিডিও ও ছবি তুলে নিলাম।
শুয়ে থাকা বিশাল হনুমানজির মূর্তিটির দর্শন করতে হলে কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে হয়। ছোট জায়গা , বিশেষ করে এখন বেশি ভীড় কুম্ভর জন্যেও।নীচে নেমে পুরোহিত এর হাতে প্রসাদের ডালা তা তুলে দিলে তিনি ঠাকুরের ফুল তুলে ডালায় দিয়ে , প্রসাদ বানিয়ে ভক্তদের হাতে ফেরত দিয়ে দেন। তাই নিয়ে , বাহিরে বেরিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে প্রস্থান দ্বার থেকে জুতো পরে ঢুখলাম সামনের একটি খাবারের দোকানে, এতো হাঁটাহাঁটি করে বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিলো তাছাড়া আমার সবকিছু জানার ও দেখার কৌতুহল এর ও তাড়না ছিল, তাই একাই ঢুকে পড়লাম। পয়সা দিয়ে কিনতে গিয়ে দেখলাম একটু অন্যরকমের ব্যাবস্থা , আগে কুপন কিনতে হবে তারপরে খাবার পাওয়া যাবে তাই করলাম । প্রয়াগরাজের জিলিপির কিন্তু তুলনা নেই , আমি প্রয়াগরাজে বড়ো হয়েছি বলে বলছি তা নয় বরং দেশের অনেক রাজ্যের জিলিপির স্বাদও নিয়েছি বলে বলছি আর তার সাথে বিদেশেও জিডিপি খাই। যাক এই দোকান থেকে জিলিপি ও ব্রেড পাকৌড়া কিনলাম। একটি পরিবারের সাথে বসে খেলাম।যদিও ইউকেতে আমি দুরকমের জিলিপি পাওয়া যেতে দেখেছি ও খেয়েছি। একটা হলো পাঞ্জাবি জিলিপি , যা নামকরা আর পুরোনো মিষ্টির দোকান , নাম ‘আম্বালা’ ও নানান সাউথহলের দোকানের যেখানে দুইপারের পাঞ্জাবিদের দোকানগুলোর (পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ও ভারতের পাঞ্জাবি ) হাঁকডাক । কিন্তু ইউকেতে আমার গুজরাতি জিলিপি খেতে ভালো লাগে। কারণ সেগুলো ছোট, পাতলা ও ভীষণ মচমচে ! পাঞ্জাবি জিলিপির মতন মোটা মোটা নয় এবং প্রচন্ড ঘন রসে ভরা নয় , আমি খুব ঘন রসের কোন মিষ্টি খেতে পারিনা। খেয়েদেয়ে আবার হাঁটা শুরু ।
ওদিকে আমার কলেজের ,( যেখানে পড়াতাম ইউকে আসার আগে) কলিগদের কিছুজনের সাথে প্রয়াগরাজের সিভিললাইনস এলাকায় দেখা করার কথা। তারা সমানে মোবাইল এ কল করছে,আমার সাথে লাঞ্চ করবে বলে , কিন্তু ট্রান্সপোর্ট পেতে হলে আমাকে অনেকটা পথ হেঁটে পেরোতে হবে , তারপর পাওয়া যাবে। তাই ওদের বলেদিলাম , যে তারা যেন খেয়ে নেয়, আমি দেখা করবো বা পারলে ওদের সাথে চা খাবো।মেলার বিরাট পরিসর শুদু হাঁটার পথ, ট্রাফিক রেস্ট্রিকশনের জন্যে । মাঝে মাঝে লাউড স্পীকারে নানান রকমের ঘোষণা শোনা যাচ্ছে , বিশেষ ভাবে ছাড়াছাড়ি হয় যাওয়া লোকজনের জন্যে । মনে পড়ে গেলো আমার ভাই ও ওর বন্ধুদের কথা ! মনে পড়তেই হাসি পেলো।
প্রয়াগরাজে একটি নামকরা ব্যাটারির বিশাল কোম্পানি ছিল , তার নাম জীপ্ ফ্ল্যাশলাইট ! তার মালিক প্রয়াগরাজের নামকরা মুসলমান শেরওয়ানি পরিবার ছিলেন । তাই বেশির ভাগ লোক সেটাকে শেরওয়ানি কোম্পানি বলতো । সেখানে বেশির ভাগ মুসলিম ও বাঙালি কর্মচারীরা কাজ করতেন। বাঙালিরা অনেকে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। এই কোম্পানি প্রতিবছর মাঘমেলায়ে এবং কুম্ভমেলায়ে নিজেদের একটি ছোট স্টেশন মতন বসাতেন, মেলায় হারিয়ে যাওয়া স্নানার্থীদের জন্যে। অনেক উঁচু করে একটা মঞ্চ করা হতো আর নিজের কর্মচারীদের ডিউটি দিতেন সেখানের নানা কাজের দায়িত্ব দিয়ে। আমাদের প্রতিবেশী হক পরিবার আমাদের খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। তাঁদের বাড়ির দুজন মেম্বার সেখানে কাজ করতেন আর তাঁদের এই সময়ে মেলার এই ডিউটি থাকতো । ছুটির দিনগুলোতে আমার ভাই বন্ধুদের নিয়ে সেখানে যেত আর মাঝে সাঝে ঘোষণা করার ডিউটি টা নিতো , মজা করার জন্যে নিজের নামেই ঘোষণা করতো , অনুপম বসু হারিয়ে গেছে , কেও যদি তাকে খুঁজে পায়ে তাহলে তাকে এতো নাম্বারের তাঁবুর কাছে নিয়ে আসুন । সে এই রকম জামা পরে আছে, ইত্যাদির বিবরণ দিতো ।যাক অনেকটা হাঁটাহাঁটির পর ই-রিক্সা পেলাম আর রওনা দিলাম সিভিল লাইনস এর প্যালেস থিয়েটারের উদ্যেশ্যে। মনে এক আলাদা ফুর্তি ও উদ্বেগ নিয়ে র ওনা দিলাম। দুজনকে বাদ দিয়ে বাকি যে কজনের সাথে দেখা হবে তাঁদের সাথে আমি ৩০ বছরের ও বেশি সময়ের পর দেখা হবে সেই ভাবতে ভাবতে এগোলাম। আমার অর্ধকুম্ভ মেলার অমৃতকুম্ভ দেখা ও পাওয়ার পরিক্রমার শেষ হলো। তাই এখানেই ইতি টানলাম।🙏