একটা কথা বলা হয়নি আমার লেখার প্রথম পর্বে , সেটা হলো যখন কুম্ভমেলায় যাওয়ার তোড়জোড় আমি ব্যস্ত তখন বোনের কাছে যাওয়ার প্লানটা ভেস্তে গেলো যেহেতু হটাৎ করে বোনকে ছেলের বাড়ি চেন্নাই যেতে হলো ! বোনের বাড়ি মেলা প্রাঙ্গনের খুব কাছাকাছি ! ঠিক হলো ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকব , যদিও ওর বাড়ি মেলার প্রাঙ্গনের থেকে অনেক দূরে অথচ এয়ারপোট এর কাছাকাছি ! ওকে ব্যাতিব্ৰস্ত করতে চাইনি , একে তো ওর শরীর ভালো নেই এবং ওর স্ত্রীও বেঁচে নেই ! ওর ছেলে-মেয়ে ও দূরে থাকে ! শেষমেশ তাই ঠিক হলো যে আমি ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠবো ! ও তো আমার সাথে যেতে পারবেনা , আমার তাহলে ত্রিবেণী-সঙ্গমে যেতে সাথে কোনো সঙ্গী হলে ভালো হয়ে ! প্রয়াগরাজের বন্ধু গায়েত্রী অগ্রবাল ও আশা শর্মা কে বললাম ! দুজনেই বললো , “চলে এসো , সঙ্গ দেব” !
এর আগে প্রয়াগরাজের এয়ারপোর্ট কখনো দেখিনি! যেটা ছিল সেটা শুধু এয়ারফোর্সের জন্য ! তাইতেই নেহেরু , শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধীর ও রাজীব গান্ধী আসা যাওয়া করতেন (কথার প্রসঙ্গে বলি , এ নিয়ে ও আমাদের বেশ গর্ব ছিল যে দেশের চারজন প্রধানমন্ত্রী ই প্রয়াগরাজের + বিগ বি -অমিতাভ বাছান)! আর একটা কারণ আমার দেশ ছাড়ার পর পাবলিক এয়ারপোর্ট হয়েছে, খুব কম ফ্লাইট আসে, সেও আবার দিল্লি থেকে আর কোনো ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট আসেনা এবং ডোমেস্টিক ফ্লাইট গুলো সপ্তাহে এক দুদিন করে যায় তাও দিল্লি তে, কলকাতায় নয় !
এই কুম্ভ মেলার উপলক্ষ্যে কয়েকটা ডোমেস্টিক ফ্লাইট কলকাতা থেকে আসাযাওয়া করছিলো এবং সেই জন্যেই এয়ারপোর্ট কে সুন্দর করা হয়েছে , এখনো কাজ চলছে ! এয়ারপোর্টের চত্বরের জায়গায় বেশ গাছ পালা ও দেয়ালে কুম্ভমেলার আঁকাবুকি দিয়ে বেশ জবর সাজিয়েছে দেখলাম ! ভাই গাড়ি ও তার ড্রাইভার নিয়ে এসেছিলো , এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম ! ভাই সব বোঝাচ্ছিলো , কুম্ভমেলার জন্যে কি কি করা হয়েছে ! তারপর ওর বাড়ি এলাম ! বিশাল বাড়ি , একা থাকে সাথে ওর দুজন অবাঙালি বন্ধু ! তাদের পরিবার গ্রামে আর তারা প্রয়াগরাজে কাজ করে ! তাদের থাকা-খাওয়া ফ্রি ওর কাছে আর তারা আমার ভাইয়ের দেখাশোনা ও সঙ্গ দেয়! দেখে ভালোই লাগলো যে ও একাকিত্বে বোধ করেনা! বেশ গুলজার হয়ে থাকে বাড়ি ! ও চিরকালই বেশ আড্ডাবাজ ! এতো কিছু বলছি কিন্তু কুম্ভমেলাটা যে কি সেটা বলা হয়নি।
২০০১ সালে পূর্ণ কুম্ভরমেলার সময়ে যুক্ত রাজ্যের চ্যানেল ফোরে ধারাবাহিক ভাবে এই পূর্ণ কুম্ভমেলার একটি প্রোগ্র্যাম চলেছিল এবং তার মূল প্রতিপাদ্য গানটি বাংলায় ছিল, ‘কুম্ভমেলা, কুম্ভমেলা , কুম্ভমেলা যাবো সখি ‘! তখন এই বাংলা গানের কলিটি শুনে আমার বাংলাদেশী ছাত্ররা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল , “মিস, কুম্ভমেলা কি ?”তাই একটু বলেনি , এই কুম্ভ মেলার সম্পর্কে।দেবতাদের ও অসুরদের মধ্যে চুক্তি হয়ে যে তাঁরা মহাজাগতিক বা ব্রহ্মান্ডের সমুদ্র মন্থন করে অমৃত কুম্ভ বার করে তার অমৃত পান করে অমরত্ত্ব অর্জন করবেন। সেই চুক্তি অনুযায়ী আরম্ভ হলো সমুদ্র- মন্থন এবং তার জন্যে দড়ি হিসেবে বৃহৎত্তকার নাগবাসুকি সর্প কে ব্যাবহার করা হয়েছিল। সাপের ল্যাজার দিকে দেবতারা ও অসুরেরা ফণার দিকে ধরে সমুদ্র-মন্থন করে অমৃত পেলেন। মন্থন করণ কালে অনেক কিছু আবির্ভূত হলো, এমনকি বিষ ও। সেটাকে শিব পান করে নিলেন কিন্তু তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গেলো। এই জন্যে তাঁকে নীলকণ্ঠ ও বলা হয়ে। শেষমেশ ধন্বন্তরী, স্বর্গের চিকিৎসক, তিনি একটি কুম্ভ হস্তে অবতীর্ণ হলেন। সেই কুম্ভে ছিল অমৃত আর সেটাকে ভগবান বিষ্ণু, মোহিনী রূপ ধারণ করে বিতরণ করার ভার নিলেন। বিতরণের সময়ে একদিকে দেবতারা যখন অমৃত পান করবেন বলে বসেছেন তখন রাহুকেতু নামের একটি অসুর এসে দেবতা সেজে দেবতাদের মধ্যে বসে অমৃত পান করে আর ভগবান বিষ্ণু ওকে চিনে ফেলে সুদর্শন চক্র দিয়ে গলা কেটে দিলেন। যেহেতু সে কিছুটা অমৃত পান করেছিল তাই তার মুন্ডু ও ধড় আলাদা হয়েও অমরত্ব পেলো – রাহু ও কেতু নামে । সেই অমৃত, অমরত্ব প্রদান করবে আর তাই নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ্য আরম্ভ হয়। তখন বিষ্ণুর বাহন গরুড় অমৃত কুম্ভটি নিয়ে পালালো স্বর্গের পথে। গরুড় যখন সেটিকে নিয়ে অসুরদের টানা-হেঁচড়ার দ্বন্দ্বের থেকে পালিয়ে ছুটছিল তখন সেই কুম্ভ থেকে অমৃতর চারটি ফোঁটা চারটি জায়গায় পড়েছিল – হরিদ্বার , উজ্জৈন , নাসিক ও প্রয়াগ। সেই কারনেই এই স্থানগুলোঅয় কুম্ভমেলা হয়, যদিও একই সময়কালে নয় ।
বলে নাকি এইসব জায়গার নদী গুলোতে অমৃত প্রবাহিত হয়ে থাকে কুম্ভ স্নানের সময়। প্রয়াগের কুম্ভমেলার অন্যান্য জায়গার কুম্ভের চেয়ে মাহাত্ব একটু বেশি। তার প্রথম কারণ হলো এখানে তিনটি নদীর(গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী ) সঙ্গম, দ্বিতীয় কারণ ব্রহ্মা সৃষ্টি করার জন্যে এখানে যজ্ঞ করেছিলেন এবং তৃতীয় কারণ প্রয়াগরাজ কে সব তীর্থস্থানের মধ্যে বড়, তাই এর নাম তীর্থরাজ প্রয়াগ। এখন নতুন নামকরণ প্রয়াগরাজ ।প্রয়াগরাজ বা এলাহাবাদের কুম্ভমেলা দিনক্ষণ ধ্যার্য করা হয়ে গ্রহবিজ্ঞান ভিত্তি করে। প্রয়াগরাজের কুম্ভের সময়টা নির্ধারিত করা হয়ে বৃহস্পতি ,সূর্য ও চন্দ্রর রাশি গতিবিধির চক্র অনুযায়ী – মেষে বৃহস্পতি এবং মকরে চন্দ্র ও সূর্যের অবস্থানগত কাল হতে হবেই। পুরাণে বর্ণিত যে চারটি স্থানে যে চার ফোঁটা অমৃত পড়েছিলো সেই জন্যেই এই জায়গাগুলিতর এক ঐশ্চর্যিক মাহাত্ম্য আছে।
সমুন্দ্র মন্থনের দৃশ্যটা আমার কাছে বইতে আঁকা-বুঁকি দেখা ছবিগুলো হয়ে ছিল অনেকদিনধরে। কিন্তু যখন থাইল্যান্ড ব্যাংককের আন্তর্জাতিক সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট এ গিয়ে দেখলাম এই সমুদ্র মন্থনের জীবন্ত বৃহত দৃশ্য, আমি শুধু হতবাক হয়নি বরং ভীষণ ভাবে সম্মোহিতও হয়েছিলাম। আশাতীত অপূর্ব সে দৃশ্য একটি বৌদ্ধ ধর্মীয় দেশে, আমাকে আরো বেশি অবাক করেছে। সারাদিন যেন সেটির দিকে চক্ষু মেলে থাকি , ধর্মীয় কিছু না ভেবেই । কি অপূর্ব ও বিশাল পুরো সমুদ্র মন্থনের দৃশ্য। থাইল্যান্ডের মণি-মানিক্য দিয়ে গড়া সব দেবতাদের ও অসুরদের জামাকাপড় ও গহনাপত্র। অনেকেরাই হয়তো জানেন যে থাইল্যান্ড দ্বিতীয় শ্রেণীর মণি -মাণিক্যের জন্য বিখ্যাত। টুরিস্ট -গাইডরা সব সময়ে মণি-মাণিক্যের দোকানগুলি , ফ্যাক্টরি তে নিয়ে যান ।সমুদ্র মন্থনের একটি সাঙ্কেতিক অর্থ আছে । মানুষের মন হলো একটি বড়ো মহাসাগরের মতন। সেটি অনেক স্মৃতি ও অভিজ্ঞাতায় পরিপূর্ণ । সেগুলোর ধ্যান , চিন্তা, মনন , আরাধনা ও ঈশ্বর ভক্তি দিয়ে মাঝে-মাঝেই মন্থন করা উচিত। সেই উদ্দেশ্যটা জেনেই হোক বা না জেনেই হোক মানুষজন কল্পবাস, স্নান , ঈশ্বরের নাম গান করেন এই কুম্ভমেলায়ে এসে।এ সম্বন্ধে আমি সংক্ষিপ্ত করে বললাম।বিস্তারিত জানাতে গেলে আমার কুম্ভমেলার অভিজ্ঞাতার কাহিনীটি খেই হারিয়ে ফেলবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে আমার কাহিনীটি নিয়ে এগোবো।(চলবে )🙏
ছবি: নিনারা