জাপানে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে হাইকুর জন্ম হয়েছিল। এটি একটি ক্ষুদ্রতম বিন্যাসের কবিতা বা পদ্য। হাইকু শুধুমাত্র তিনটি লাইনের কবিতা কিন্তু এইটি পাঠককের  আবেগ ও বোধজ্ঞান কে একটি বড় কবিতার পর্যায়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে । হাইকুর সবচেয়ে বড়  আকর্ষণশক্তি হলো এর ভাব বা কল্পনার সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশ করার ক্ষমতা ও নিয়ম মেনে প্রকাশ করা।হাইকু  নিজস্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে মাশাওকা সিকি (১৮৬৭ -১৯০২) হাইকুর মতন ছোট পদ্যের লাইন বড়ো পদ্যের প্রস্তাবনা হিসেবে ব্যবহার করতেন। এই ছোট কাব্যের লাইনগুলো কে জাপানি ভাষায় হাইকু বলা হয়।

একটি বড় পদ্যের একটি সমীক্ষার মতন যাকে আমরা ইংরেজি তে প্রিলিউড (prelude) বলি সেই ধরণের পদ্য। কিন্তু এই বড়ো কবিতার প্রস্তাবনার পংক্তিগুলো পরবর্তীকালে স্বাধীনভাবে হাইকু নামে জন্ম নিলো। হাইকুর মূলরূপ তিন পংক্তির  ৫, ৭ , ৫ নিয়মে বাঁধা ছন্দে হতেই হবে। এই ছন্দের নিয়ম ভাঙা চলবেনা আর এইটাই হোল প্রাচীনতম হাইকুর বিন্যাস। মাসাওকা শিকির( Masaoka Shiki)  হাইকুর জন্মদাতার  এই নিয়মবধ্যতা তার পূর্বসূরই ও সমসাময়িক হাইকু কবিরা মাৎসুও বাশো(Matsuo Basho),  ইয়োশা বুসন( Yosa Buson) , তাকাহামা কিওশী(Takahama Kyoshi),  নাকাতসুকা ইন্সপেক্টর (Nakatsuka Ippekiro) এবং হারা সেকিতেই (Hara Sekitei) পালন করেছেন।

সময়ের তালে তাল দিতে গিয়ে হাইকুর এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দিয়েছে সেটা হোল পদ্যের ৫, ৭ , ৫ এর ছন্দের নিয়মটাকে বাধ্যতামূলক ভাবে বজায় রাখা, আর সেটাই হোল হাইকুর মূল প্রতিপাদ্য। যদিও হাইকুর আরম্ভ কালে হাইকুর মনোভাব কে এমন ভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাহার মধ্যে ঋতুর আস্বাদন বা তার দৃশ্যপটের প্রকাশ থাকবেই। শীত, গ্রীষ্ম, শরৎ, বসন্ত বা অন্য কোন ঋতুর কথা ও তার, সঙ্গে যুক্ত প্রকৃতির পরিবর্তনের উল্লেখ হওয়া অনিবার্য। এই পরিবর্তন বিশেষ কোন পাখি বা প্রস্ফুটিত ফুলের রঙের বা নদীর জলের তরঙ্গ এবং বিশেষ ঋতুর তাপমাত্রা সংক্রান্ত বিবরণ হতে পারে। তাই  গোড়ার দিকের হাইকুতে এমন একটি ভাব প্রকাশ করা হোত যার সাথে ঋতুর যোগ অনিবার্য ছিল। তাছাড়া কোনরকমের উপমা, রূপক, প্রতীক ও রূপকবর্ণনা ইত্যাদি বাক্যালঙ্কার বর্জিত ছিলো। কেবলমাত্র সঠিক ভাব প্রকাশ করাই হাইকুর নিয়ম ছিল। 

ইংরেজি ভাষায় হাইকুর আবির্ভাব হয় ফরাসি ভাষার সৌজন্য। কারণ  জাপানের হাইকুর পাশ্চাত্য দেশে প্রথম প্রকাশ পায় ফ্রেঞ্চ ভাষায় এবং তার অনুবাদ হয় ইংরেজি ভাষার। তবে সময়ের সাথে হাইকুর নিয়মে পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক হাইকু শুধুমাত্র অনেকটা বদলায়নি বরং উল্টো নিয়ম মেনেই চলছে। এখন  সেই হাইকু কে উচ্চস্থানে বসানোর ধারা চলছে যেগুলোতে বর্নালঙ্কারের ব্যবহার করা হয়। যাইহোক তিন পংক্তির  ও  ৫, ৭ , ৫ এর ছন্দে (metre) হাইকু,রচনা অনিবার্য। শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যেই নয় ভারতে প্রথম হাইকুর আবির্ভাব হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১৩ তে লেখা ‘জাপান যাত্রী’ ভ্রমণ কাহিনী বইটির সূত্রে। এই ভ্রমণ কাহিনীর বইটিতে কবিগুরু  রবীন্দ্রনাথ জাপানের বিখ্যাত মাৎসুও বাশোর দুটি হাইকুর অনুবাদ করেন। যদিও  রবীন্দ্রনাথ ৫, ৭ , ৫ এর ছন্দের (metrical) নিয়ম না মেনেই অনুবাদ করেছেন আর সেই নিয়মটা মাসাওকা শিকির ( Masaoka Shiki) সময়কাল থেকে হাইকুর রচনার জন্য আজও অনিবার্য। জাপান,  চীন ভ্রমণ কালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাইকু লিখে হাত পাখা, রুমাল ও কাগজে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথের পর সুরেন্দ্র নাথ মৈত্র অনেকগুলো হাইকুর রচনা করেন তাঁর লেখা , ‘জাপানী ঝিনুক’ নামের বইতে। আরো কয়েকজন বাংলা ভাষায় হাইকু রচনা করার চেষ্টা করেছেন ও করেও চলেছেন। তাদের মধ্য দুলাল মজুমদার বেশ চমৎকার হাইকুর রচনা করেছেন। যদিও হিন্দী ভাষায়ে প্রচুর সংখ্যক হাইকুর রচনা হয়েছে ও হয়ে চলেছে। যদিও প্রকৃতির তেমন বর্ণনা অপরিহার্য নিয়ম না মেনেই। দেশের বাইরে বসবাসকারী ভারতীয়রা হিন্দি ভাষায় অনেক হাইকুর রচনা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।আধুনিক জাপানী হাইকু কবিদের বিশ্বাস যে হাইকুর রচনার আসল গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হোল আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান দেয়া-নেওয়া করা।

হাইকুর কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি না লিখলে আমার এই লেখাটি সম্পূর্ণ হবে না।

১. হাইকু কম কথায় বিস্তারিত কথা বোঝায়।

২. হাইকুর ৫,৭,৫ ছন্দের রচনাশৈলী মেনে চলে।

৩. হাইকু আমাদের চারপাশের পরিবেশের সৌন্দর্যের মর্ম উপলব্ধি করাতে সাহায্য করে।

৪. হাইকু প্রকৃতির সঙ্গে নিকট সংযোগ সৃষ্টি করে।

রবীন্দ্রনাথের লেখা দুটি হাইকু এখানে দিলাম যদিও ৫,৭,৫ ছন্দের নিয়ম তিনি মানেননি। বাংলা ভাষায়ে নিয়মটা মেনে চলা বেশ কঠিন। 


The beauty of rain captured by Mastsuo Basho is so vivid yet simple in the expression:
In the twilight rain these brilliant hued hibiscuses A lovely sunset.
Nature Soseki brought out the stillness of the night very evocatively in these lines:
The lamp once outCool stars enter the window frame.


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা হাইকু:
স্বপ্ন আমার জোনাকি
দীপ্ত প্রাণের মণিকা
শুপ্ত আঁধার নিশিথে
উড়ছে আলোর কণিকা।

প্রজাপতি সেতো বরষ না গণে,
নিমেষ গণিয়া বাঁচে,
সময় তাহার যথেষ্ট তাই আছে।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজী হাইকু:
The butterfly does not count years,   
but moments    
and therefore has enough time.

The mist tries
To capture the morning
In a foolish persistence. 
The pomegranate bud hidden behind her veil
With burst into passionate flower
When I am away.

আমার কয়েকটি হাইকু তিনটি ভাষার: বাংলা, হিন্দী ও ইংরেজীর  এখানে দিলাম। হাইকু রচনা করার নেশা আমাকে প্রকৃতির সান্নিধ্য নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার ইন্ধন যুগিয়েছে। আগে প্রকৃতির সৌন্দর্য চোখে পড়তো,  ভালো লাগতো কিন্ত এখন আমিই প্রকৃতির সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াই আর তার  সান্নিধ্য উপভোগ করি। বলতে গেলে আমারই তার সান্নিধ্য খুঁজে বেড়ানোটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।এই দীর্ঘমেয়াদী ঘরবন্দী জীবনের প্রকৃতির সান্নিধ্যকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ফলপ্রদ তেমনই জরুরি, তেমনটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্ররা বলছেন। যাক এখানেই আমার হাইকুর রচনার সামান্য জ্ঞানের বহর প্রকাশ করলাম। হিন্দিতে যাকে বলে, “ছোটে মুঁহ বড়ী বাৎ।”

ছবি : পপি দে

LET’S KEEP IN TOUCH!

We’d love to keep you updated with our latest news and offers 😎

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.