যার জন্যে যাওয়া সেই দিনটি এসে গেলো। মানে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ – শাহী স্নানের মানে রাজকীয় স্নানের পঞ্চম দিন এসে গেলো। আগের দিন রাতে বন্ধু গায়েত্রী কে সব প্লান বললাম । সকাল বেশ বেলার দিকে মানে সকাল ১০ টা নাগাদ ভাইয়ের গাড়ীতে তার বন্ধু সাথে রওনা দিলাম সেই গন্তব্য স্থলে প্রথম যেখান থেকে বন্ধু গায়েত্রী কে তোলা হবে , তারপর ত্রিবেণী সঙ্গমের উদ্দেশ্যে যাত্রা হবে শুরু। প্রয়াগরাজের কে পী কলেজের সামনে ভাইয়ের গাড়ীতে আমরা দু-তিন মিনিট অপেক্ষা করামাত্র গায়ত্রীর দেখা পেলাম রিক্শায়, আমাদের দিকে আসছে। ওকে গাড়ীতে তুলে সেই বালুআঘাটের( এ ঘাট যমুনা নদীর ঘাট , এখান থেকে নৌকো করে গঙ্গায়ে যাওয়া যায় ) পথে রওনা হলাম, ওলিগলি ও আঁকাবাঁকা পথ ধরে।
বড় রাস্তায় সর্বত্র ট্রাফিক রেস্ট্রিকশান, কোন গাড়ি- রিক্সা যেতে দেবে না। শুধু পথচারিরা যেতে পারবে ।যাক শেষমেশ নির্বিঘ্নে বালুআঘাট পৌঁছানোর কাছাকাছি আমার ইউইং খৃস্টান কলেজ এর গেটের কাছে গাড়ি থামলো। কতো স্মৃতি! এই কলেজের । স্নানের বিশেষ দিনগুলোতে স্কুল-কলেজের সাথে অফিস-কোর্ট-কাছারি ও বন্ধ থাকে কারণ ট্রাফিক রেস্ট্রিকশন । মানে রীতিমতো ছুটির দিন । তাই গেটের সামনে বসে গেছে সব্জিওয়ালারা সুযোগ ও জায়গা নিয়ে । তাও স্মৃতিসুধার উপকরণ হিসেবে ‘কুছ পরোয়া’ নেই বলে একটা নিজের ছবি তুলিয়ে নিলাম।কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আমি আর গায়ত্রী হাঁটা পথ ধরে ঘাটের দিকে এগোলাম বোট ধরবার উদ্দেশ্যে ।
অনেকেই এসেছেন ওই ঘাটে আমাদের মতন বোটে করে ত্রিবেণী সঙ্গমে যাবেন । একটা বিশালাকার মোটরবোট এলো আর আমাদের সহযাত্রীরা ভাড়া নিয়ে দরাদরি শুরু করলো ! সেটা যখন ঠিক হলো তখন আমি ও গায়েত্রী থলে প্যাঁটরা নিয়ে উঠে পড়লাম , গায়েত্রী শুধু আমার সঙ্গ দিতে এসেছে , সে স্নান করবেনা কারণ সে আগেই মহাস্নান করে নিয়েছে ! হ্যাঁ, মোটরবোটে ওঠার আগেই পথে কয়েকটা দোকানী বসে শুদু প্লাস্টিকের কন্টেইনার বিক্রি করছিলো নানা সাইজের আর তাতে লেখা ছিল গঙ্গাজল ! তারমানে সেই উদ্দেশ্যেই আমদানি করা ! আমি দুটো বেশ ছোট মাপের কিনলাম ! মোটরবোটে ওঠার পরই দেখি দুজন পুলিশ কর্মচারী এসে বোটওয়ালা কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তারপর আমাদের সবাইকে এ বলে নামিয়ে দেয়া হলো যে এ বোট সঙ্গমে যেতে দেয়া হবেনা ! বোটওয়ালা বেআইনি ভাবে সেটাতে সবাইকে তুলেছে.! ওই ঘাট থেকে নিয়ম অনুযায়ী অতবড়ো বোট চালাবার অনুমতি নেই , যাত্রীদের সুরক্ষার জন্যে ! দেখলাম তাকে লাইসেন্স এর কাগজপত্র দেখাতে বললো !
যাক সবাই হুড়মুড় করে আমরা নামলাম , তবে আমার এইটা দেখে বেশ আনন্দ হলো যে পুলিশেরা সৎভাবে কাজ করছেন ,ঘুষ না নিয়ে ! কিছুক্ষনের মধ্যেই একটি ছোট মোটরবোট এলো, আবার সেই যাত্রীদের দরাদরি , সে আমাদের আবার যাত্রীদের জন্যেই অপেক্ষা করবে আর স্নান হয়ে গেলে যে ঘাট থেকে তুলেছিল সেই ঘাটেই ফেরত নিয়ে আসবে ! প্রয়াগের স্নানের একটি বিশেষত্ব বলা হয়নি সেটা হলো এখানে পাকাঘাট নেই যেমনটি কাশী, হরিদ্বার , দক্ষিনেশ্বর , বাগবাজার গঙ্গার ঘাট আছে ! যমুনায় আছে! তার কারণ হলো একে গঙ্গা এখানে একদম স্থির হয়ে থাকেনা , সে চঞ্চলা ও বাচ্চাদের মতন হেথায়-সেথায় ঘুরে বেড়ায় (যদিও এখন বাঁধ ইত্যাদির জন্যেই সেই রকম চঞ্চলা ভাবটা কে বাঁধন দেয়া হয়েছে) !
আসল কারণটি হলো যে পাড়ে কেও তেমন স্নান করতে আসেনা , স্নানার্থীরা তো ত্রিবেণী সঙ্গমে পবিত্র স্নান করতে আসেন ! আর এ ত্রিবেণী সঙ্গম তো মাঝখানে হচ্ছে – তিনটি নদীর মিলন – গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী ! সরস্বতী অন্তৰ্নিহিতভাবে প্রবাহিত হয়ে তাই তাকে দেখা যায়না , তবে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায় পরিষ্কার ভাবে , গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গম এর ! যতই দেখি তারে ততই সম্মোহিত হয়ে পড়ি ! গঙ্গার ঘোলাটে সাদা জল আর যমুনার নীল পরিচ্ছন্ন জল এক দামাল শিশুদের মতন ঘুর্নিরত অবস্থায় অবিরাম চলছে ! কোনো মতেই তাদের কেও থামাতে পারবেনা অথচ এ দুরন্ততার মধ্যেও তারা মিলেমিশে একাকার হচ্ছেনা ! যে যার রূপে গুনে নিজের সত্তা টাকে বজায় রেখেছে ! তাইতো আমরা চাক্ষুস দেখে বলতে পারি কোনটি গঙ্গা আর কোনটি যমুনা ! এ প্রকৃতির এক অপরূপ দৃশ্য ! সরস্বতী কে কেন দেখা যায় না তাই নিয়ে একটি লোককাহিনী আছে ! রামচন্দ্র পৃথিবী তে আসেন ঈশ্বরের অবতার স্বরূপে ! তাঁর উদ্দেশ্য পাপ কে বিনাশ করা আর সেই পাপের হর্তাকর্তা ছিলেন রাবন ! সুতরাং তাকেই ধ্বংস করতে তিনি আসেন ! যখন তাঁর রাজতিলকের সমস্ত ব্যাবস্থা হয়ে গেছে , তিনি রাজা হবেন তাইনিয়ে তোড়জোড় চলছে , তখন দেবতারা সরস্বতী কে কুঁজো মন্থরা দাসী হয়ে রামচন্দ্রের রাজপরিবারে যেতে বললেন ! রামচন্দ্রের রাজা হওয়ার সম্ভাবনা কে নষ্ট করতে ! মন্থরার মন্ত্রনাতেই রামচন্দ্র আর রাজা হতে পারলেননা এবং তাঁকে ১৪ বৎসরের বনবাসে পাঠানো হলো !
অযোধ্যা থেকে সীতা ও লক্ষণের সাথে বনবাসে যাবার সময়ে তিনি গঙ্গা পার হয়ে প্রয়াগে ভার্গবমুনির আশ্রমে কটাদিন এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ! সেই সময়ে সরস্বতী নদী নাকি রামচন্দ্রের ওই বনবাসী রূপ দেখে নিজেই নিজের কীর্তির জন্যে এতো লজ্জিত বোধ করলেন যে তিনি লোকচক্ষুর বাইরে লুকোবার জন্যে অন্তর্নিহিত হয়ে গেলেন ! এই লোককাহিনী সত্যি হোক বা না হোক , সে নিয়ে আমার কোনো ভাবনা কোনোদিনই হয়না কিন্তু এ সব ধরণের লোককাহিনী আমার ভীষণ ভালো লাগে , আমাকে কাছে টানে , আমার শুনতে ও জানতে ভালো লাগে , নিছক সরল এক ভালোলাগার জন্যে ! আমি সব কিছুতেই লোককাহিনী খুঁজে বেড়াই ! চিরকালই সেই জন্যেই নৌকা করেই স্নান করতে ত্রিবেণী-সঙ্গম স্থলে যেতে হয়ে ! সেখানে কিন্তু হাঁটুজল , তবে জলের তলায় সাংঘাতিক কারেন্ট !
আমি যদি যমুনা ঘাট থেকে না হয়ে সোজাসুজি গঙ্গায়ে আসতাম আমাকে নৌকা ভাড়া করেই সঙ্গম স্থলে যেতে হতো তার কোনো বিকল্প নেই ! বাঁধানো বা পাকা ঘাট নেই তাই কাঠের বড়ো বড়ো চৌকি পাতা থাকে সঙ্গমস্থলে যেখানে নৌকা এসে থামে আর স্নানার্থীরা তাইতে নেমে জলে স্নান করতে নামেন !এবারে কুম্ভের জন্যেই দেখলাম একটা বিরাট অস্থায়ী জামা -কাপড় ছাড়া ও পরার ঘর করা হয়েছে সেখানে ! কিন্তু হলে কি হবে ওই একটা ঘরের কাছে তো এতো নৌকা যেতে পারছেনা ! যেমন জায়গায় – জায়গায় কয়েকটা চৌকি পাতা থাকে সে রকম , কয়েকটা ঘর করা উচিত ছিল , একজায়গায় একটা বিশাল ঘর না করে ! আর এ সব রাজকীয় স্নানের দিন তো প্রচন্ড ভীড় ! আমি কখন নৌকোর ট্রাফিক জ্যাম হতে দেখিনি যা এবারে কুম্ভমেলায়ে দেখলাম ! সে সাংঘাতিক ভাবে মাঝে মাঝে এক একটার সাথে ঠোকাঠুকি লাগছে আর আমরা সব যাত্রীরা চমকে চমকে উঠছি ! শেষমেশ নৌকাওয়ালা সেই জামাকাপড় ছাড়ার ঘর অবধি পৌঁছতে পারলোনা শত চেষ্টা করেও ! আমরাও নেমে পড়লাম জলে ডুব দিতে ! একমাত্র আমার বন্ধু গায়েত্রী বসে রইলো নৌকোতে! কারণ সে স্নান করবেনা!
প্রয়াগরাজের শীতের সকাল, তারপর গঙ্গার ঠান্ডা জল , একবার নেমে পড়লে আর শীতের বালাই নেই আবার থাকলেও এতো লোক সবরকমের বয়েসের স্নানে নেমেছে! এ জলে স্নানের মেসমেরাইসিং অভিজ্ঞাতা এক অদ্ভুত এনার্জির সৃষ্টি করলো! যেন মনে হলো গেয়ে উঠি আরো , আরো দেও প্রাণ ! আগেই বলেছি আমি তেমন ধার্মিক নই আবার অধার্মিক ও নেই কিন্তু এটা আমার কাছে এক বিশাল মেলায় যোগদান করার আনন্দ , আমার জায়গায়, আমার শহরের , যেখানে আমি বড়ো হয়ে উঠেছি !
এমনিতে বলে কুম্ভে স্নান করাটাই পুণ্য কাজ, তবে চলতি কোথায় শাহী স্নানের দিনগুলো তে স্নান করা আরো পুন্য সংগ্রহ করা ! শাহী মানে হলো রাজকীয়-যোগ যুক্ত দিনগুলি – এবারে ছয়টি দিন ছিল – মকর সংক্রান্তি , পৌষ পূর্ণিমা, মৌনী অমবস্যা, বসন্ত পঞ্চমী , মাঘী পূর্ণিমা ও শিবরাত্রি ! এ সবকটার নিজস্ব মাহাত্ম্য আছে ! যে হেতু আমি মাঘী পূর্ণিমার স্নান করার সুযোগ পেয়েছি তাই তাঁর মহিমার কথা বলবো ! মাঘী পূর্ণিমার দিন দেবগুরু বৃহস্পতির পুজো করা হয়ে ! এইদিনে দেবতারা স্বর্গ থেকে নেমে এসে কুম্ভের স্নান করেন ! তাই স্নানার্থীরা এইদিন স্নান করলে অদৃশ্যে দেবতার অর্ঘ্য পান এবং সশরীরে স্বর্গে যাবার পুণ্য লাভ করেন ! স্নান করার সময়ে বলে গঙ্গায়ে তিন ডুব দিতে হয়ে ! তিন ডুব দিলাম বেশ ভালো করে , নৌকাওয়ালা বললো ,তিনটি ডুব দেবার সময়ে গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতীর নামে দেবেন ! আমার মনে নেই নাম নিয়েছিলাম কিনা , কারণ তখন আমি জলে নেমে এক অদ্ভুত আনন্দে ডুবে গেছি ! তারপর প্লাস্টিকের কন্টেইনার দুটোতেই গঙ্গাজল নিলাম ! একটি খোলা চৌকিতে দাঁড়িয়ে জমাকাপড় ছেড়ে ,ভিজেগুলো নিয়ে নৌকায় উঠলাম ! ইতিমধ্যে নৌকো থেকে গায়েত্রী আমার কয়েকটা ছবি তুললো !
কালকূটের লেখা ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ‘ বইটিতে লেখা , যেন কিছুটা যদিও সবটা নয় আমার অনুভূতির সাথে ঠিক ঠিক উৎরে গেছে ! “মানুষের এ অনুভূতির তীব্রক্ষনে , সে বড়ো একলা ! এ একাকীত্বর বেদনা যত গভীর , আনন্দ তেমনি তীব্র ! মানুষের একাকী মুহূর্তে তাঁর ঘর বাঁধা মন মানুষের হাটের মাঁঝে যায় হারিয়ে! তখন সে যতটাই একলা ততটা দোকলা “! একা সুদূর দেশ থেকে গিয়ে আবার একাই স্নানে নেমে পড়েছি , তখন কেওই সঙ্গে নেই একটুকুও অনুভব করিনি। একাকীত্বর গভীর বেদনা একটু ও বোধ করিনি কারণ আমি নিজেই এ একাকিত্ব বেছে নিয়ে এসেছি, তাঁর সাথে আমার জীবনের মূল প্রতিপাদ্য, রবি ঠাকুরের , ‘একলা চলো রে ‘,যে আছে । কিন্তু আনন্দটা সত্যিই দুর্দান্ত তীব্র ! আমার মন খুব একটা ঘর বাঁধা নয় আমি চিরকালই বেড়াতে , দেখতে ভালোবাসি কিন্তু এতো মানুষের হাটের মাঝে এক অদ্ভুত সম্মোহিত করা পরিবেশে নিজেকে একলা ও দোকলার আনন্দ সমানতালে পেয়েছি ! এইটাই আমার কাছে যতটা বিরাট পাওনা ততটাই অতুলনীয় অপরূপের দর্শন ! (চলবে )🙏