১৭ই ফেব্রুয়ারী এলাহাবাদ পৌছিয়ে পরের দিনই বেরিয়ে পড়লাম প্রয়াগরাজের আদি বাজারের দিকে। সেখানে একবার যাওয়া চাই আর তাঁর নাম হলো ‘চৌক’ ঘন্টাঘর মানে মাঝখানে ক্লক টাওয়ার, বলতে হয়ে রিক্সাওয়ালাদের বা অটোওয়ালাদের। যদিও রিক্সায় ব্যাবহারের বেশি প্রথা সেখানে , অনেক ই-রিক্সাও চলছে আজকাল । এতো ঘিঞ্জি , চারিদিকে শুধু দোকানপত্র , এলোপাতাড়ি ভাবে ঠেলাওয়ালাদের ভিড় , নানাধরণের জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে , খেলনা , জামাকাপড় , মৌসুমী ফল – কলা , মৌসুমী লেবু , আঙ্গুর , পেয়ারা , কূল , চীনাবাদাম ভাজা , চিনাবাদামের গুড়ের চাকতি , (হিন্দি তে বলে মুংফালি কি পাট্টি) , ছোলাভাজার গুড়ের চাকতি (হিন্দি তে দাল কি পাট্টি) , তিলের গুড়ের চাকতি (হিন্দি তে তিল কি পাট্টি) , স্টিলের বাসুন, চাট বা চটপটা , বাচ্চাদের জুতো , ব্যাগ , মোজা , গেঞ্জি, কি নেই ? মাঝে মাঝে ট্রাফিক পুলিশ এদিক ওদিক যেতে বলছে তখন অন্য জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ।আবার সময়ে সুযোগ দেখে যেখানে দাঁড়ায়ে সেখানে ঠ্যালা নিয়ে চলে আসে।
এই ‘চৌক’ নিয়ে কত স্মৃতি ? সেই ছোট বেলায় বাবা-মায়ের সাথে ভাই বোনেরা এখানে আসতাম। নতুন বই খাতা কিনতে , নতুন ক্লাসে উঠলে , পুজোর জামা-কাপড় ও বাটার জুতো কিনতে । এগুলো একেবারে ছকে বাঁধা ছিল। তাছাড়া আরো নানা কারণে আসা হতো ছোটবেলায়। বড়ো বেলায়ে নিজেরই শত কারণে । এ ঘন্টাঘরের কাছেই একটি সরু গলি আছে আর তারমধ্যে তিন -চারদিক দিয়ে ঢোকার রাস্তা , ভেতরে সারি দিয়ে সমস্ত দোকান আর প্রায় সব দোকানেরই বিক্রেতা মুসলমান। তাঁরা বেশির ভাগ মেয়েলি জিনিসপত্র বিক্রি করেন। তাই সেখানে গেলে বেশির ভাগ মহিলা ক্রেতাদের দেখা যায়।
মেয়েদের হ্যান্ড ব্যাগের দোকান , এমব্রয়ডারির সমস্ত জিনিসের দোকান পত্র , মেয়েদের টয়লেট্রিজ এর দোকান ,আর্টিফিশিয়াল গয়নার দোকান ও বাচ্চাদের খেলনায়ে ভর্তি দোকান।সলমা-চুমকি, জরি , সেলাইয়ের সুতোর রীল , কাঁচ বসানোর কাজের কাঁচ কিনতে হলে এ গলিতে ঢুকতে হবে । এ গলিটার নাম হলো ‘গড়বড় ঝালা’ । সেখানে ঢুকলাম কাঁচ-বসানোর এমব্রয়ডারি জিনিস কিনবো বলে , জানলাম আর সেগুলো বিক্রি হয়না আজকাল আর সেগুলো কেউ নিজে হাতে করেনা , রেডিমেড কেনে । সেই এক ঐতিহ্যবাহী এমব্রয়ডারির কাজটা উঠে গেলো? এটাকে মিরর এমব্রয়ডারি বলা হয়ে , হিন্দি তে শীশে কে কাম( কাঁচ কা কাম নয় , কারণ এ কাঁচগুলো আসলে শুধু কাঁচ নয় আয়না, হিন্দি তে আয়না কে শীশা বলা হয়ে ) । শেষমেশ আরেকটা দোকানের সন্ধান পেলাম। সেখানে ছিল আর সেই দোকানদার আমাকে খদ্দের হিসেবে পেয়ে ভীষণ আশ্চর্য হলো। গোটা কতক প্যাকেট কিনলাম ।
সেই সব পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। চৌক বাজারের কাছেই আর একটা বাজার , তার নাম – লোকনাথ। সেখানে শুধু খাবার দাবার পাওয়া যায় ! লোকনাথের মিষ্টি , রাবড়ি , পাঁপড়, আচার , মসলা-বড়ি মসলা পাতি , শাক সবজি তেলের ঘানি থেকে তেল কেনা , সেই ছোটবেলা থেকে দেখা লোকনাথের তিলমাত্র বদলায়নি। ঠিক সেই দোকানগুলো , সেই ভাবেই জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। চারিদিকে দেখে যেন মনে হলো সময়টা এখানে এসে থেমে আছে। একটুও এগোয়নি বা পেছোয়নি।কি করে ছবি তুলবো , তাই নিয়ে রাস্তার চৌমাথায় এদিক ওদিক দেখছি , এক মহিলা আমার কাছে এসে হিন্দি তে বললেন, ‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে , এখানে থাকেন না । ছবি তুলবেন ? দিন আমি তুলে দি ।” আমি মুচকে হেসে আমার মোবাইলটা দিলাম আর তিনি ছবি তুললেন । আমি ধন্যবাদ দিলাম তাঁকে। তারপর মোবাইল ফেরত দিয়ে মহিলা , ‘নমস্তে’ বলে চলে গেলেন ।
ঢুকলাম সময়ের তালে থেমে থাকা লোকনাথের বাজারে । প্রয়াগরাজের লোকনাথের লঙ্কার আচার , হরি নমকিনের দোকান থেকে চানাচুর ও দমালু-মসলা(আলুর দমের মসলা ) কিনলাম । পাসের দোকানে দেখি তিলক কাটা এক দোকানদার স্তূপাকার তিলের মিষ্টি ( তিলগুলো কে শুকনো খোলায় ভেজে , আদভাঙা করে গুড় বা চিনি দিয়ে চাকতি মতন বানায়ে -নরম পাকের বা শক্ত/কড়া পাকের যেটাকে ‘গজক’ বলে) বিক্রি করছে আর এক টুপি পরা , লম্বাদাড়িয়ালা মুসলমান ভদ্রলোক গোছা-গোছা গজক কিনছেনা আর আলাদা-আলাদা প্যাকেট করিয়ে নিচ্ছেন। আমার এতো অবাক লাগছিলো যে আমি তিনি চলে যাওয়ার পর দোকানদার কে জিগ্যেস করলাম, “উনি এতো গজক কিনে কি করবেন ?” আমি বলি আর না বলি আর যতই ভালো স্থানীয় হিন্দি বলি , এতো বছর দেশের বাইরে থাকার একটি ছাপ পড়ে আছে , যেটা দেখলে লোকে বুঝতে পারে আমি স্থানীয় নই, সেটা ভারতের যেখানেই যাই। এমনকি কলকাতায় গেলেও তাই হয়। যাইহোক দোকানদার বললো , “এখন শীতের সময়ে , লোকেরা শীতের উপহার মতন নিজের আত্মীয় স্বজনদের উপহার দেয়।” বুঝলাম শীতের তত্ত্বের মতন , যেমন মেয়ের স্বশুর বাড়ি লোকে আমের সময়ে আম -জ্যাম – কাঁঠাল পাঠায়ে , সেই রকম ব্যাপারটা। এটা কোনো ধর্ম বিশেষের নয় এটা হলো অঞ্চল হিসেবে – ইউপির লোকেরা তাই করবেন। তাঁরা হিন্দুই হোক বা মুসলমানই হোক। দেখে বেশ আনন্দ হলো। আমিও কিনলাম ভাইয়ের জন্যে।
প্রয়াগরাজের পেয়ারা বিখ্যাত। তাই কিনে বাড়ি ফেরার জন্যেই একটা ই-রিকশা করলাম। এলাহাবাদে যে রিকশাওগুলো ব্যাটারী বা ইলেকট্রিক এ চলে সেগুলো কেই ই-রিক্সা বলে !বাড়ি ফিরে ভাইকে বললাম যে পরের দিন ১৯ ফেব্রুয়ারী , মাঘী পূর্ণিমার স্নান , আমি হুড়োহুড়ি করে ইউ কে থেকে এসেছি, কোথাও কোনো বুকিং বা ব্যাবস্থা করা হয়ে ওঠেনি, কি করে যাবো ? শাহী স্নান বলে ট্রাফিক রেস্ট্রিকশন , শেষমেশ যাওয়া হবে কিনা ? এই নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করছি। ও বললো চিন্তা করোনা , “আমার সাঙ্গো-পাঙ্গো রা ঠিক ব্যাবস্থা করে দেবে।” যাক তিনজন বন্ধু এলো। একটা মিটিং হলো । এদিকে আমার বন্ধু গায়েত্রী যাবে তাকেও আমার প্লানটা বলতে হবে , আমরা তখন এক জায়গায় দেখা করবো এবং এক সাথে যাবো । মিটিং এ ঠিক হলো যে আমার ভাইয়ের গাড়িতে আমরা ওর বাড়ি থেকে বলুয়াঘাট, সেটা যমুনা নদীর ঘাট , সেখান অবধি ছোটমোটো অলিগলি দিয়ে যাবো , যে সব জায়গায় ট্রাফিক রেস্ট্রিকশন থাকবেনা । সেই ঘাট থেকে বোট যাচ্ছে , সেই বোট এ করে ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করতে যাওয়া হবে । বন্ধুকে সমস্ত ডিটেলে জানিয়ে দিলাম। ( চলবে )🙏
ছবি: নিনারা